Biography

আবদুর রশিদ পাঠান। পিতা মরহুম আনছার আলী ও মাতা মরহুমা ফাতেমা বেগম। জন্ম ১৯৫২ সানের ৩০ জুন, চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার পালাখাল গ্রামে। সাত ভাই-বোনের মধ্যে পিতা মাতার পঞ্চম সন্তান তিনি। আব্দুর রশিদ পাঠানের শিশু ও বাল্য কালের আচরন প্রকৃতির আপন মহিমা ঘোষনা করেছিল তার বীরত্বপূর্ন ভবিষ্যতের।
প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি পালাখাল প্রাইমারী স্কুলে। কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাস করেন কচুয়া পাইলট স্কুল থেকে। মতলব কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষারত অবস্থায় পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করেন। নেতা হিসেবে গ্রহন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ইতিমধ্যে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে বীজ বপন করা হয়েছিল বাংলাদেশ জন্মের। ছয় দফা, এগারো দফার আন্দোলন যখন রূপ নেয় গন-অভ্যুথানের তখন তিনি বানিজ্য বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। তৃতীয় বর্ষে পদার্পন করতে সওরের নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিটি ছাত্র আন্দোলনে তিনি হয়ে উঠেন সন্মুখ সারির যোদ্ধা। ১৯৭১ সনে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, একই সাথে দক্ষ ছাত্রনেতা। পূর্ব বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত তখন আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ। এরই মধ্যে ডাক আসে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। অন্য বন্ধুদের নিয়ে ছুটে চলেন দূরন্ত গতিতে। গন্তব্য ঢাকা রেসকোর্স ময়দান। লাখো লাখো মানুষের সাথে উত্তোলিত হাত, কন্ঠে শ্লোগ্রান গগনচুম্বি। বঙ্গবন্ধুর দীপ্ত কন্ঠের কুশলি অথচ সুস্পষ্ট ভাষন আব্দুর রশিদ পাঠানের হৃদয়ে ও পৌছে দিল সে বার্তা, মাতৃভূমির জন্য সাজতে হবে রণসজ্জায়। গ্রামে ফিরে চলতে থাকে তারই প্রস্তুতি। ২৫ শে মার্চ ঢাকায় ভয়াল কাল রাতে হত্যাযজ্ঞের পর মানুষ ছুটতে থাকে দিকবিদিক। ঢাকা কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম শহর থেকে অগণিত মানুষ আশ্রয় নেয় মতলবের বিভিন্ন স্থানে। আব্দুর রশিদ পাঠান গ্রামের বন্ধুদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন শ্মরণার্থীদের সেবায়। পরিস্থিতি বদলাতে থাকে ক্রমাগত। অবশেষে ১৭এপ্রিল তিন বন্ধুকে সাথে নিয়ে পিতা মাতাকে না বলেই পায়ে হেটে চলতে থাকেন ভারতের পথে। লক্ষ্য একটাই যুদ্ধের প্রস্তুতি । মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা।
ভারত থেকে ট্রেনিং শেষে দেশে ফেরার পালা। সে সময়ে তাদের সাথে যুক্ত হন কয়েকজন ইপিআর জওয়ান। তাদের কাছে ছিল ২টি রাইফেল এবং ১টি হ্যান্ড গ্রেনেড। সিদ্ধান্ত হলো দেশে ফিরেই বুড়িচং থানা অক্রমনের। হলো তাই। সেখান থেকে ১৭টি রাইফেল, কয়েকটি বন্দুক ও গুলি পাওয়া গেলো। আব্দুর রশিদ পাঠান ব্যাটেলিয়ান ইনচার্জ হিসেবে দলের দায়িত্ব নিলেন। অপারেশন অভিযানে উপরে ফেলা হলো ব্রীজ। কিন্তু তারপরের দিনই হানাদার বাহিনী অক্রমন করল। আধুনিক অস্ত্রের সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব নয় বলে কৌশলে তাদের স্থান ত্যাগ করতে হলো। এরপর পুর্ণাঙ্গ ট্রেনিংয়ের এর জন্য যাত্রা করেন আগরতলার মেলাঘরে। সেখানে ভারতের কর্নেল ভাগচি, ক্যাপটেন গিল্ড ও ওস্তাদ বুর্চির কাছ থেকে গেরিলা ট্রেনিং প্রাপ্ত হলেন। পেলেন প্লাটুন কমান্ডারের দায়িত্ব । সেখান থেকে এলেন সিলেট। সঙ্গ পেলেন ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ , ক্যাপ্টেন হায়দার , ক্যাপ্টেন মাহাবুব ও খালেকুজ্জানদের। ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান দিবসে পাকিস্তানী ক্যাম্প উড়িয়ে দিতে খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বে আক্রমন করা হলে পাকিস্তানীদের পাল্টা মর্টাল শেলের আঘাতে শহীদ হন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই অপারেশনে আব্দুর রশিদ পাঠানের পেটের বাম পার্শে মর্টার শেল বিদ্ধ হলো। জরুরীভাবে হাসপাতালে অপারেশনের ফলে সে যাত্রায় তিনি প্রানে রক্ষা পান। সুস্থ হয়ে ফিরেন ক্যাম্পে। এরপর যুদ্ধের জন্য নিজ অঞ্চলে ফেরার পালা। কচুয়া, মতলবের ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধার সন্মন্বয়ে তিনি কচুয়া থানা কমান্ডার নির্বাচিত হন। দল ও রসদ নিয়ে প্রবেশ করেন কচুয়ায়।
পিতা-মাতাকে দেখার জন্য তার মন উদগ্রীব হয়ে ওঠে। কিন্তু হায়, সেখানে জানতে পারেন তার আসার সংবাদ ইতিমধ্যে পৌছে গেছে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান এসে বাবাকে বলে গেছেন রশিদ এলে তাৎক্ষনিক থানাকে জানালে সাথে সাথে তাকে ২০,০০০ টাকা নগদ পুরস্কার দেয়া হবে। না দিলে পুত্র সহ সকলকে হত্যা এবং ঘরবাড়ি জ্বালীয়ে দেয়া হবে। এই সংবাদ জেনেও আবদুর রশিদ পাঠান মোটেও বিচলিত হননি। তিনি তার দল নিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনের সংবাদ মুহুর্তেই পৌছে যায়, পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আলবদরদের কাছে। তারা ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় , স্থানীয়ভাবে কেউ কেউ কচুয়া অঞ্চলে সৃষ্টি করতে চায় অরাজকতা। কিন্তু আব্দুর রশিদ পাঠান অত্যন্ত ধীশক্তি ও বিচক্ষনতা দিয়ে তা মোকাবেলা ও পরিস্থিতি শান্ত করেন। এমনকি নিজ দলের মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর নিয়ন্ত্রনে রাখেন। তাই স্থানীয় লোকজনের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন একজন প্রিয় মানুষ-কাছের মানুষ। এরই মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাক হানাদার বাহিনীর সদলবলে বলে আত্নসমর্পনের মধ্যদিয়ে বাংলার বিজয় নিশ্চিত হলে তদানীন্তন চাঁদপুর মহকমা প্রশাসক ও সাব সেক্টর কমান্ডার সুবেদার জহিরুল পাঠানের হাতে তিনি এবং তার টিম অস্ত্র সমর্পন করেন।
এরপর ১১ বছর মংলা পোর্টে ইন্সপেক্টরের চাকুরী, পরে রাজনীতি, ব্যবসা এবং বর্তমানে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত পালাখাল আলিম মাদ্রাসার সভাপতি, কমিউনিটি পুলিশিং এর কচুয়া থানার সভাপতির দায়িত্বসহ বহু জনহিতকর কাজের সাথে নিয়োজিত রয়েছেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৃত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। বিত্ত-বৈভবের প্রলোভন দুহাতে সরিয়ে শত রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সাহসিকতার সাথে পারি দিয়েছেন জীবনের বেশি সময়। গত ২৩ অক্টোবর ২০২৩ রাত ১০.৩৩ মিনিটে এই জীবনজয়ী, আদর্শবান বীর মুক্তিযোদ্ধা ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর প্রয়ানে পালাখাল গ্রাম তথা জাতি হারালো এক সৎ, নির্ভীক সূর্য সন্তান। আল্লাহ তাঁকে এই দুনিয়ায় মতো পরকালেও সন্মানের অধিকারী করুন এবং জান্নাতবাসী করুন।
(তথ্য: নিজস্ব ও উন্মেষ এর মানপত্র থেকে)